(প্রথম পর্ব)
…তোমার চরণপবনপরশে সরস্বতীর মানসসরসে/ যুগে যুগে কালে কালে
সুরে সুরে তালে তালে/ ঢেউ তুলে দাও, মাতিয়ে জাগাও অমলকমলছন্দ হে।। …
রবীন্দ্রনাথের এই গানের পংক্তিটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে মনে এসে যায় যাঁকে দেখলে তিনি অলকানন্দা রায়।
ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যচর্চায় নিজস্ব নৃত্যধারা গড়ে তুলেছেন। ভরতনাট্যম, ওড়িশি, রাশিয়ান ব্যালে বিভিন্ন ঘরানার নৃত্য তাঁর নৃত্যশৈলীতে এসে মিশেছে স্বতন্ত্র রসায়নে। নৃত্যনির্মিতি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা তাঁর অভ্যেস। তবে সেটাই তাঁর একমাত্র কাজ নয়। তিনি সাধারণ মানুষের মধ্যে লুপ্ত থাকা নাচের ছন্দটি দেখতে পেয়েছেন অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে। তালভঙ্গের জীবনকে সুরে তালে লয়ে ভরিয়ে দিয়েছেন। আজ মানুষ তাঁকে চেনে পশ্চিমবঙ্গ সংশোধনাগারের বন্দিদের জীবনকে ছন্দে ফিরিয়ে আনা একজন অসাধারণ মানুষ হিসেবে।
শিল্পী অলকানন্দা রায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন ‘শনিবারের চিঠি’র প্রতিনিধি পাপিয়া চৌধুরী।
অলকানন্দা রায়, নৃত্যশিল্পী ও সমাজ সংস্কারক। সম্প্রতি কিশোর অপরাধীদের জীবনকে নতুন করে সাজানোর জন্য নৃত্য থেরাপিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেছেন। বিশেষভাবে সক্ষম শিশুদের এবং পারকিনসনস রোগীদের জন্য নৃত্যকে থেরাপি হিসেবেও ব্যবহার করছেন। এবং এর উল্লেখযোগ্য প্রভাব দেখা যাচ্ছে। ২০১৯ সাল থেকে ট্রান্সজেন্ডার এবং পশ্চিমবঙ্গের অ্যাসিড আক্রমণ থেকে বেঁচে যাওয়াদের জন্যও নৃত্যকেই মাধ্যম বা ‘টুল’ করেছেন। দুই দশক ধরে, তাঁর নৃত্য আঙিনায় থাকা প্রায় দু’শো জন সংশোধানাগারের বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং প্রায় কেউই অপরাধে ফিরে যায়নি। সংশোধনাগারের অভ্যন্তরে এই ধরনের কাজ বিশ্বজুড়ে অতুলনীয় হয়ে উঠেছে। পুরুষ ও মহিলা বন্দিদের সঙ্গে সাংস্কৃতিক অনুশীলন ব্যবহারে সক্রিয়ভাবে জড়িত ও সফল হয়েছেন অলকানন্দা রায়। সংশোধনাগারে তিনি সকলের ‘মা’ হয়ে উঠেছেন। তাঁর এই অসাধারণ কাজের মূল চাবিকাঠি হল প্রেম, যত্ন, সঙ্গীত ও নৃত্য কীভাবে ঘটনা, উপাখ্যান এবং অনুভূতির একত্রে একত্রিত হয় তা নিয়ে প্রক্রিয়া। সঙ্গীত এমনই এক আশ্রয়। কথায় কথায় কত কিছু যে আদান প্রদান হ’ল তারই কিছু রইল পাঠকদের জন্য।
মেয়েবেলার কথা
ছোট থেকেই অলকানন্দা রায়ের নাচের প্রতি ঝোঁক। চার বছর বয়সেই প্রথম মঞ্চনৃত্য। মায়ের উৎসাহ, বাবারও নীরব সমর্থন পেছন থেকে। বললেন, “ছোট থেকেই নাচতে ভালবাসি। আর সেই জন্যই মা, বাবা যা যা করণীয় করেছেন। আমার মামাবাড়ি নাচ-গানের বাড়ি। মা খুব সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন।‘ সি.এল.টি-তে ভর্তি করে দেওয়া হয়, ওখানে সবরকম নাচই শেখানো হ’ত। মঞ্জুলিকা দাশের কাছে নৃত্যশিক্ষা। পরে মুরুথাপ্পা পিল্লাই ভরতনাট্যম ক্লাস নিতেন। কোনওদিনই বাঁধাধরা নিয়ম বা চিন্তা ভাবনা ও প্ল্যান করে চলিনি। মর্ডান হাই স্কুলে, ক্লাস-থ্রি বোধহয়, ব্যালে ক্লাস নিতেন ক্যাথরিন, ক্যালকাটা স্কুল অফ মিউজিকেও শেখা পিয়ানো। বেড়াতে গেলাম ভুবনেশ্বরে, বিমানদা একটা চিঠি লিখে দিলেন সংযুক্তাদিকে (পানিগ্রাহী)। ওড়িশি শেখার কোনও ইচ্ছা ছিল না, বিমানদার চিঠি নিয়ে দেখা ও চিঠি দিতেই গেছিলাম দিদির কাছে।
চিঠি পড়ে দিদি বললেন— ‘আমি তোমায় শেখাব।’ একটা ভাল দিন দেখে যেতে বললেন। গেলাম। শুরু করলেন মঙ্গলাচরণ দিয়ে। মে মাস। ওড়িশার ওই গরম, তখন দিদি থাকতেন টঙ্কপানি রোডে। যেতাম অটোতে। একমাসে মঙ্গলাচরণ, বটু ও কল্যাণ পল্লবী শেখালেন হাত ধরে। দিদি পারফরমার ছিলেন, টিচার নয়। কিন্তু আমায় শিখিয়েছেন। তাই গর্ব করে বলি— আমিই একমাত্র স্টুডেন্ট। ওয়ার্কশপ নিতেন। রবীন্দ্রসদনে প্রথম ওড়িশি নৃত্যের অনুষ্ঠানে শুরু কেলুচরণ মহাপাত্র পাখোয়াজে। দিদি মন্দিরায় ও রঘুনাথ পানিগ্রাহীজি সঙ্গীতে— খুবই স্মরণীয় ঘটনা। দিদি বেশ পজেসিভ ছিলেন আমার ব্যাপারে। দিদির অবর্তমানে আর শিখিনি। কোনওদিন দিদিকে অনুকরণ করিনি, সেটা দিদি অ্যাপ্রিসিয়েট করতেন।
জীবনতরঙ্গে ভেসে
১৯৬৯-এ মিস্ ইন্ডিয়ার ফার্স্ট রানার আপ। তখন ডেকে নিয়ে যেত এখনকার মতো কোনও গ্রুমিং ছিল না। নিজেদেরই সাজতে হ’ত। ডেকেই নিয়ে গেল, গিয়ে যা পারি করলাম। কোনওটাই প্ল্যানড্ নয়, জীবনে। জীবনে যেমন এসেছে সেভাবেই চলেছি ও করছি। কম্পিটিশনে বিশ্বাস নেই, নিজের স্কুলেও কোনও পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। পরীক্ষা দিয়ে ডিগ্রি দিয়ে কখনও আর্টিস্ট হওয়া যায় না। ট্রিনিটি কলেজ অফ লন্ডনের ডিপ্লোমা আছে পিয়ানোতে। দক্ষিণীর ডিপ্লোমা আছে রবীন্দ্রসংগীতে, কিন্তু নাচে ডিগ্রি, ডিপ্লোমা, সার্টিফিকেট কিছুই নেই।”
হেসে বললেন আমাদের মুন্নিদি, ‘ অন্য দুটো কিছুই করি না, নাচটাই ভালবাসি, সেটাই করি।‘
পণ্ডিচেরিতে শ্রীমায়ের আশ্রমে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা, দেখা হওয়ার মুহূর্তটা মনে হয় আশীর্বাদ। বাবা ছিলেন পুরো সারেন্ডারড্ মায়ের কাছে, সেই সূত্রেই যাওয়া। মা-কে প্রণাম করলে উনি আমার দিকে এক অর্ন্তভেদী দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন, মনে হচ্ছিল যেন ভেতর থেকে সব ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসছে, আর অঝোরে কেঁদে যাচ্ছি। ভাবছিলাম, আমি নিশ্চয়ই সিনার্ আর কেউ তো অমন করছে না। সমস্ত শরীর কাঁপছিল, কোনও কন্ট্রোল নেই নিজের ওপর। মায়ের দিকে তাকাতেই এমন হয়। কী পাওয়ারফুল চোখ। ভাবছিলাম আমার কেন এমন হচ্ছে! মা, আশীর্বাদ করে ফুল দিলেন, কথা বললেন খুবই স্বাভাবিক তখন। চলে এলাম, কাউকে কিছু বলিনি, তখন সতের বছর।

যখন আমার বিয়ে ঠিক হল, বাবা বললেন, মায়ের কাছে দুজনের ছবি পাঠাবো। যদি উনি বলেন, তবেই অগ্রসর হব। ছবি পাঠানোর পর মা আমাদের দু’জনকে একসঙ্গে দেখতে চান। আমরা গিয়েছিলাম। মা আমাদের অশীর্বাদ করেন। ওখানে মায়ের সামনে যুগলে অশীর্বাদ নেওয়াতেই বিয়ের মান্যতা দেওয়া হয়। এটা খুবই বিরল ঘটনা, সবার এরকম হয় না, হয়তো দু-একজনের জীবনে মায়ের সামনে আশীর্বাদী বিয়ে হয়েছে। তাই মনে হয় আমি খুবই ব্লেসড্! চন্দনকে (হাজব্যান্ড) খুব তাড়াতাড়ি হারিয়েছি, কিন্তু মা সবসময় প্রোটেক্ট করেছেন।
তব নৃত্যের প্রাণবেদনায়
কোনও কিছু নিয়ে চিন্তা করি না, খামখেয়ালি, আনপ্ল্যানড, কারুর ক্ষতি বা সমালোচনায় যাই না, কোনও সুযোগ আসলে, মনে হলে করি, নয়তো বিরত থাকি। কাউকে ঠেলে ফেলে কোনও কিছু করি না। আমার মতো করেই কাজ করি, যে যার মতো ভাল থাকে থাক, কোনও কিছুতে ভয় করি না, জানি মা আমায় সেই সাহসটা জোগায়। অনেকে বলেন, আমি আরও অনেক কিছু করতে পারতাম নাচে, কিন্তু সেটা চাইনি, কোনও বাধ্যবাধকতায় যেতে চাইনি কখনও। মুক্ত আত্মায় বিশ্বাস করি, তাই স্বাধীনতাকে খর্ব করে কাজ করতে পারি না। খুব আনন্দ করে নাচ ও কাজ করতে ভালবাসি।‘ বম্বেতে অশোক কুমারের ছেলের বউ, ওঁরা রজনীশের আশ্রম ‘ওশো’কে খুব মানে, ওঁদের সঙ্গে গিয়ে আশ্রমে তিন-চারদিন থেকে যেটা খুবই আকৃষ্ট করে ও ভাল লেগেছে সেটা ফ্রিডম্, অরবিন্দ আশ্রমেও সেটা পাই। একটি মেয়ে একটা ফুল হাতে নিয়ে সারা আশ্রম ঘুরে ঘুরে নেচে বেড়াচ্ছিল, সেটা খুবই নাড়া দেয়, ভাবি এমনও হয় আশ্রমে। অবশ্যই নিয়ম আছে, কিন্তু তার মধ্যেও স্বাধীনতাও আছে। অদ্ভুত পরিবেশ। ছোটবেলা থেকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, মা-বাবা কখনও কিছু চাপিয়ে দেননি। যেটা ইচ্ছা হয়েছে সেটাই করতে পেরেছি, তাই হয় তো অন্যের ফ্রিডমের ভ্যালুটা বুঝতে পারি ও দিই। পছন্দও নিজস্ব স্পেস্। কোনও পুজো-আচ্চা রিচুয়ালসের মধ্যে নেই, পুজো মানে জ্ঞানত অন্যের ক্ষতি না করা। কাউকে কষ্ট না দেওয়া। মানুষের জীবনে ওঠাপড়া থাকেই, খুবই তাড়াতাড়ি হাজব্যান্ড চন্দন রায়কে হারাতে হয়। সুর, তাল, ছন্দের বদল ঘটে, নতুন সুরে, তালে ছন্দে নতুন করে শুরু করা। যেটা হবার সেটা হয়। দুঃখবিলাসী না হয়ে আবারও এগিয়ে চলা। বেচারা হয়ে না থাকার প্রয়াস, পিছন ফিরে না তাকানোয় বিশ্বাসী। ‘চন্দনালোক’ নাচের স্কুলের সৃষ্টি হয় হাজব্যান্ডের স্মৃতির ও উৎসাহের কথা মনে করেই। সব সময় উৎসাহ দেওয়া ও অনুষ্ঠানের জন্য কলকাতায় প্লেনে করে চন্দনই নিয়ে আসত। নইলে হয়তো আসতাম কিনা কে জানে!
এমনই খামখেয়ালিপনা ছিল, স্মৃতিমেদুর হয়ে বলেন অলকানন্দা।
আনন্দলোকে ‘চন্দনালোক’-এ
“ও চলে যাওয়ার পর এক সিনিয়র পাইলটের স্ত্রী চিঠিতে লেখেন—‘হি ওয়াজ সো প্রাউড অফ ইউ, কখনও নাচটা ছেড়ে দিও না। রিমেমবার এভরি পারফরম্যান্স অফ ইওরস উইল বি শ্রদ্ধাঞ্জলি টু হিম।’ অনেকদিন এমন মনে হয়েছে— আর বোধহয় নাচতে পারবো না, কিন্তু পরে আস্তে আস্তে শুরু করি। সংযুক্তাদি খুবই ভালবাসত চন্দনকে, আর চন্দনও চাইতো – ও বলতো স্কুল করার জন্য, আমি চাইতাম না কোনও বাধ্যবাধকতায় যেতে। চলে যাওয়ার পরে দিদিই বলেন স্কুলের কথা এবং আমাদের দু’জনার নামের মিশ্রণেই ‘চন্দনালোক’। চলে যাওয়ার প্রায় এক বছর পরেই স্কুল, অনেক সময় মনে হয় স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার কথা। কিন্তু ওই নামটার জন্যই আটকে যায় বন্ধ করার ভাবনা। কোনও ডিউটি হিসাবে নয়, কারুর জন্য কিছু করতে ভালো লাগে। নতুন নতুন কিছু করতে ভাল লাগে। ‘ইন্সপিরেশন ফাউন্ডেশন’ স্লাম চিলড্রেনদের নিয়ে করা হয়েছিল, পরে মনে হয় কেনই বা ওদের আলাদা করে রাখবো! তাদের আমার স্কুলে নিয়ে নেওয়া হয়। ফ্রিতেই শেখে, যারা ভাল করে। ওদের নিয়ে জাপানে যাওয়া হয়েছে পাঁচবার। অনেক কিছু করার ফলে মনে হয় জীবনটা পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে। সবাইকে নিয়ে চলতে ভাল লাগে, নিজের জন্য শুধু বাঁচা নয়। অন্যের জন্য কিছু করতে নিজের ভাল লাগার জন্য, তাদের ভাল লাগল কিনা সেটা পরের কথা। সাহায্য নিতে ভাল লাগে না, মনে হয় ডিউটি হিসাবে নয়, ছাত্রছাত্রী ও সন্তানদের বলি, কেউ যেন আমার জন্য ডিউটি হিসাবে কিছু না করে। টিচার বা মা বলে যদি মন থেকে আসে, তবেই কিন্তু কোরো। যেটা মন থেকে আসবে সেটা ন্যাচারিলি আসবে।”
সংশোধনাগারে সকলের ‘মা’ হয়ে ওঠা খুব মসৃণ ছিল না। আমেরিকার জেলেও গিয়েও নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে। সেই সব অভিজ্ঞতার কথাই হচ্ছিল। সেসব কথা তুলে ধরা যাবে পরের পর্বে।